Medical Science and Technology

অপরাজিতা

উত্তম কুমার এর লেখা অপরাজিতা

এ রুক্ষ শহর থেকে মাটির গন্ধ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কনক্রিটের ক্রমাগত গাঁথুনি ছেয়ে ফেলেছে পুরো জমিন। ব্যস্ততা কেড়ে নিয়েছে এ শহরের সময়। আলোহীন এ শহরে কেবলই নিয়ন বাতির আলোয় চকমকে রাত অপরাজিতা হয়ে থাকে।

নির্ঘুম নির্জনতার বুকে ঢলে পড়া নগরী। এখানে ব্যস্ততায় ছেয়ে গেছে সমস্ত কিছু। কতশত অচিন মানুষের ভীড়ে ভরে ওঠা নগরীর আরেক নাম তিলোত্তমা। পিচঢালা পথ আর কনক্রিটের কারুকাজে নিস্প্রাণ নগরী তবু সকলের প্রাণ সঞ্চারে আশাজাগানিয়া।

বিলাসবহুল আয়েশের ঘরে কারো নিদ্রাবিহীন রাত কেটে যায় দিনের পর দিন আবার কারো মাথার ওপর সুবিশাল আকাশটায় আশ্রয় মাথা গোঁজার। কোনরকম একটুখানি খালি জায়গা, রাত্রির আহবান চোখে ঘুম বয়ে আনে। যার যার মত করে এ নগরীর প্রতিদিনের সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত থেমে নেই। সন্ধানী মানুষ কতরকম চাহিদা পূরণের তাগিদে দৌড়ঝাঁপে ব্যতিব্যস্ত থাকে। দিনশেষ নিজের ঘর, সংসার। ঘরহীন সংসার পাতা মানুষই কম নেই এখানে।

সদ্যজাত পাখির ছানাকে বুকে আগ্লে রেখে মা পাখির আহারের সন্ধানে রোজকার ছুটোছুটির মত। দুমুঠো আহার সন্ধানী মানুষের সংখ্যায় এ শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠের তালিকায়। এরা নাম ডাক কামাতে এ নগরীর বড় কর্পোরেট শাখার কর্তাবাবুদের স্মরণ করে না, আধিপত্যবাদের নেশায় বুদ হওয়া তাদের বিষয় নয়, নরম তোষকের বিছানা কিংবা এসির আয়েশী কোন কামরাও নয়। শুধু পেটের দায় বলে যেখানে তারা ঠেকে গেছে তাদের বিশ্বাস এ শহরের কানাগলিতে তাদের একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্বাসের এ খড়গটা এক ধুধু মরুর বুকে বড় গম্বুজের মিনারের মত। এ বিশ্বাসকে বুকে করে এ নগরী তার তিলোত্তমা নামকে ধারণ করে নিয়েছে।

চোখ ফেরালে উঁচু উঁচু দালানকোঠার ফাঁকে ফাঁকে খড়কুটো, টিনের চাল আর পলিথিন দিয়ে বানানো ঘরগুলো সুখের সম্ভারে গুটি গুটি বেদনার ছোপের মত। উঁচুতলার লোকদের চোখে এগুলোয় যারা থাকেন তারা ভিন্ন কোন প্রাণী কিন্তু তাদের শরীরে রক্ত মাংস আছে, তাই মানুষ না বলে উপায় নেই। সূর্যের আলোর ছিটেফোঁটা পৌঁছালেও সভ্যতার আলোকে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ঐ বড় বাড়ির সীমান প্রাচীরে, দারোয়ান আর সিসি ক্যামেরা বসিয়ে তার সর্বক্ষণ নজরদারি রাখা হয়েছে। বেঁচে থাকতে পরিচয় সবার জন্য মূখ্য হয়ে উঠে না, সবার পরিচয় হয়ে উঠে তেমনও নয়।

এই অবহেলা, অনাদরে আলো বায়ুর সান্নিধ্যের পরশ বিনে একটা অপরাজিতার লতা দিন দিন বেড়ে উঠেছে। ছোট ছোট শাখে তাতে নীলাভ প্রজাপতির মত পাখনা মেলে ফুটেছে অপরাজিতা। গন্ধহীন কত ফুলই তো নিজের নাম পরিচয় অব্দি পায়নি আবার নামহীন ফুল অকাতরে গন্ধ বিলিয়েছে পথে, প্রান্তরে। অপরাজিতা হেসে হেসে ফুঁটে উঠে এ অবহেলার শহরে। গন্ধহীনতা তার লাবণ্যকে অস্বীকার করতে পারেনি, ম্লান করতে পারেনি, সৌন্দর্যকে ভূলুন্ঠিত করতে পারেনি। অপরাজিতা নীলাভ মেঘহীন শরতের আকাশের স্বরবর্ণের মত। বিশালকায় দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এ নগরী এক মন সংকীর্ণতার ভীড়ে, ব্যস্ততার মাঝে ক্লান্তির ফাঁকে ফাঁকে নতুন কুঁড়ি হয়ে নিজস্বতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে। লোকচক্ষুর আড়ালে নিজের রুপলাবণ্যে অদম্য যুবতীর মত, বৃষ্টিস্নাত রাতে এক পশলা বৃষ্টির শেষে কাঁচা সোনালী রঙের মত।

দেয়ালের রঙে, ঝরাপাতার শব্দে যেমন বাঁচে জীবনানন্দ, শোষিত মানুষের প্রতিবাদ বিপ্লবে বাঁচে নজরুল, প্রেমে দ্রোহের মিশেলে রবীন্দ্রনাথের মত। আকাশের ঠিকানায় প্রেমিকার চিঠিতে রুদ্র মুহাম্মদের মত অপরাজিতার রেশ রয়ে যায়। মানুষ বর্তমানকে পরিপূর্ণ করতে কত কসরত করে! ভাবনাহীন ভবিষ্যতের জন্য দিনাতিপাত করে অসহ্যতার সাথে বুকে নিয়ে সোনালী অতীত। সমাজে অপরাজিতাদের সামনে পাহাড়সম বাঁধার শেকল, অঙ্কুরিত হয়েও পরিস্ফুটিত হওয়া আটকে যায়। দীর্ঘকাল থেকে বানের পঁচা জলের মত প্রবাহিত সব আচার, বিধি তেড়ে আসে, বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, গন্তব্যের পান থেকে ছিটকে ফেলে দূর কোন লক্ষ্যে তা থেকে ফেরা দুরূহ আর তাতে স্থির থাকাও আরো কঠিন। অপরাজিতাদের দমে যাওয়া ঝড়ো হাওয়ার মত সাময়িক, ক্ষণিকের। মেঘের আঁধার কেটে সূর্যরশ্মির মত আলোকোজ্জ্বল হয়ে, সমাজের দূর্ভেদ্য দেয়াল ফুঁড়ে অপরাজিতার মতই অবহেলায় অনাদরে কতক মানুষ প্রস্ফুটিত হয় নগরীর কনক্রিট ভেদ করে। সুউচ্চ অট্টালিকার দেয়াল ফুঁড়ে।

আলোবাতাসের নির্মম শূন্যতা বুকে নিয়ে তবুও বেড়েই উঠে। সমস্ত দূঃখ বেদনায় বিষাক্ত দেহে তবু সুউচ্চ উন্নত মমশিরে। জীবনের ঘাত প্রতিঘাত, অনাদর অবজ্ঞাকে দুপায়ে ঠেলে নিশঙ্কচিত্তে সহাস্যে। সমস্ত না থাকাকে অবলীলায় গ্রহণ করে, নীরবে নিভৃতে, জোয়ারের শেষ ঢেউটার মত। অপরাজিতাদের খর্বাকায় আকৃতি, প্রকৃতি, মননই যেন কাঙ্ক্ষিত, সমাজ অপরাজিতাদের দিকে আঙুল তুলে পৈশাচিক আনন্দবোধ করে, মানসিক স্বস্তি পাবার চেষ্টা করে, তাচ্ছিল্যের মাঝে নিজেদের অপরিমেয় শান্তি লাভ করে।

খুব গল্পই অপরাজিতাদের জীবনলেখ্য হয়, খুব কম আলোচনায় তাদের ওঠে আসা। নিভৃতচারীর মত গোপনে বা সঙ্গোপনে তাঁদের বেড়ে উঠবার আঁতুড়ঘর, সেখানেই বৃদ্ধি কিংবা ঝড়ে পড়া। বসন্তের চকচকে পাতা বুকে নিয়ে যে বৃক্ষ নবরূপে শোভিত হয় তারই বুক থেকে মর্মর শব্দে হলদে পাতার ঝরে যাওয়ার খবর চাওর হওয়ার সুযোগ থাকে না। অপরাজিতাদের পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা শেষাবধি চলমান থাকে কিন্তু যে পরিস্ফুটিত হওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার বুকে লালন করে তাকে রোধ করা যায় না, থামানো যায়না। খানিক পথদীর্ঘ করে সময়ক্ষেপণ করা যায়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কাছে কখনও কখনও অপরাজিতরা কুঁড়িতে ঝরে যায়, কলুষিত আঁধারে হারায় দিশা, অতলান্তে বিলীয়মান তারার মত হারিয়ে যায়। গন্ধহীন ফুলের মত লাবণ্যে, নামহীন অজ্ঞাতনামা হয়েও মোহনীয়তায় অপরাজিতাদের অস্তিত্ব সদা জাগ্রত, সদা বিরাজমান।

বৈষম্যঠাসা এ সমাজের কোণায় কোণায়, রুক্ষতা ঠাঁসা এ নগরের প্রাণে মুক্ত বায়ুর সঞ্চার করে, রঙিন প্রজাপতির মত সান্নিধ্য আর জোনাকির মত আপন মহিমায় আলোকিত করে যায়। আপন আলোর গাঢ় রঙের আলপনার মত ছড়িয়ে যায় আপন বর্ণ। যার বিচ্ছুরিত আবিরের রঙে শুভ্রতার শরতের শিউলী ফোটে, তারার মেলা বসে দূরাকাশে। অপরাজিতা তুমি বীর সদর্পে সটান হয়ে উদ্যত হও মহাকালের কাছে।

Uttam Kumar
Medical Science and Technology professional
B.Sc in Dentistry (University of Dhaka)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *