আমার ফেরার সীমাবদ্ধতা জেনো পৃথিবী, আমার অপরাগতা মেনে নাও। জ্ঞান আর বুদ্ধির আড়ষ্টতা তুমি স্বীকার করো। চারদিকের চোখ ধাঁধানো সফলতা দিয়ে তোমার গ্রহে বসবাস করা মানুষগুলি দিনরাত আমার ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলে রেখেছে। বিজয়ের নিক্তি ধরে সারাদিন আমার পরাজিতের ওজন মেপে যাচ্ছে।
প্রান্তে প্রান্তে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ব্যবহারের জয়োৎসব কিন্তু চারিদিকে এর অপব্যবহার দেখতে দেখতে আমি এর সঠিক ব্যবহার ভুলে গেছি। তোমার বিশালতার কাছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই আমাকে সর্বময় নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তোমার গ্রহে ভুল ঠিকের মারপ্যাচে আমাকে কেবল সঠিকটাই করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
না এখানে ভুল করেও ভুল করার কোন উপায়ন্ত নেই। সব ঠিক করতে গিয়ে তো আমি কেবল ভুলই করেছি আর তার তিরস্কারের মুকুট মাথায় নিয়ে ঘুরছি। তার শাস্তির মাত্রা ঠিক কতটুকু হতে পারে তুমি তা কোনদিনও ভাবতে পারবে না। সফলতার মন্ত্রে দীক্ষিত করার জন্য এখানে পাঠশালা খোলা আছে সেখানের পুস্তিকায়, গল্পে, সাহিত্যে কেবল সফলতার গল্পগাথা রচিত, খচিত, উদ্ধৃত, ব্যাপ্ত । ব্যর্থদের কোন ইতিহাস নেই৷ ইতিহাসে কোন ঠাঁই নেই, কোন স্থান নেই, গালগল্প নেই। মহাকালের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বিজয়ীদের রণধ্বনি, বৈষম্যখচিত এ মহাকাল কেবল সফলদের গল্প মোড়ানো।
আমার সমগ্র জীবন কেবল ব্যর্থতার বালুচরে মুখ থুবড়ে পড়া, অপ্রাপ্তির কোন চলমান গল্প। আমার চেষ্টাগুলির কোন নাম নেই, দাম নেই, স্বীকারোক্তি নেই। অথচ আমাদের শিক্ষালয়ে আমাদের দুই-ই পড়ানো হয়েছে, জানানো হয়েছে, বলা হয়েছে, শেখানো হয়েছে। বাস্তবতায় নাকি সব শেখার স্বীকৃতি নেই। আমার সমস্ত প্রচেষ্টার ছোট ছোট অনুকাব্যগুলোকে ব্যর্থতার লালকালিতে গোল বৃত্ত এঁকে আমাকে কেবলই অপারগ, ব্যর্থ, ছোট বলে হেয় করা হয়েছে।
বৈষম্যের এ উঁচুনিচু পাহাড়ের গা বেয়ে সুদীর্ঘ পথ ধরে আমি নিরন্তর ছুটে চলেছি কিন্তু এই আমাকে আমি আর পথ দেখাতে পারিনা, বরং পায়ে ঘুঙুরের মত শক্ত শেকল বেঁধে অদৃশ্য কিছু আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক ভারবাহী জীবের মত, এক পোষ মানা পরাস্ত হাতির মত, ক্ষুধার্ত সিংহের মত। হাঁটতে হাঁটতে আমি বহুদূর, বহুপথ, বহুকাল পেছনে ফেলে এসেছি, বহু জীবন গত হয়ে গেছে, বহু ইচ্ছার অপমৃত্যু হয়েছে কিন্তু তবুও আমি বেঁচে আছি, আমার বক্ষপিঞ্জরের বায়ুর ক্রমাগত গমন নির্গমন হচ্ছে। আমার স্নায়ুতে ক্ষীণ অনুভূতি মিহি লোমের মত বিদ্যমান।
তাই এখনও আমি হাসি, কাঁদি, নড়াচড়া করি। অথচ, কবেই আমার অনুভূতির মরণ হয়েছে, আমার চোখের জল শুকিয়েছে, আমার হৃদয়ের পাঁজর ভেঙেছে। তোমার কাছে তুচ্ছ আমি কেবলই বিচার্যবস্তুর মত এ ছোট জীবনটাকে দেয়ালে টানানো একটা ঘড়ির কাছে সপে দিয়েছি তাই। তোমার মানুষগুলির অপবাদে নীরব নিথর আমার জীবাত্মা। তাদের হিসেবের উপাদান হয়ে আমার দিনাতিপাত। আমি বার বার হারিয়ে যায় অতলে, ঢেউয়ের তোড়ে আবার ভেসে আসি রোজ।